তীর্থংকর
জৈনধর্মে একজন তীর্থঙ্কর হলেন এক সর্বজ্ঞ শিক্ষক, যিনি ধর্ম শিক্ষা দেন। / From Wikipedia, the free encyclopedia
তীর্থংকর (সংস্কৃত: जैनतीर्थङ्कराः, অনুবাদ 'হাঁটুজল-প্রস্তুতকারক') হলেন জৈনধর্ম অনুসারে রক্ষাকর্তা এবং ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু।[1] মূলত তীর্থংকর শব্দটি দ্বারা তীর্থের প্রতিষ্ঠাতাকে বোঝায়;[2] কিন্তু জৈনধর্মে তীর্থ বলতে বোঝায় সংসার নামক জন্ম ও মৃত্যুর অন্তহীণ চক্রকে। জৈনদের মতে, তীর্থংকরেরাই ধর্মের সর্বোচ্চ শিক্ষক। কারণ, তাঁরা এই সংসার নামক জন্ম ও মৃত্যুর চক্রকে নিজেরা জয় করেছেন এবং অন্যদের সামনে অনুসরণীয় এক পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন।[3] আত্মার সত্য প্রকৃতি অবগত হওয়ার পর তীর্থংকরেরা কেবল জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা অর্জন করেন। তীর্থংকর সংসার থেকে মোক্ষ অর্জনের জন্য সেতু হিসেবে অন্যদের কাছে নতুন শিক্ষকও প্রদান করে যান।[4]
জৈন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী, কালচক্র দুই ভাগে বিভক্ত: "উৎসর্পিণী"[5] বা উর্ধ্বগামী কালচক্র ও "অবসর্পিণী" বা অধোগামী কালচক্র (বর্তমান কালকে শেষোক্ত কালচক্রের অন্তর্গত মনে করা হয়)। বলা হয় যে, প্রত্যেক কালচক্রে ঠিক চব্বিশ জন করেই তীর্থংকর এসে মহাবিশ্বের এই অংশের উপর করুণা বর্ষণ করেন। পূর্ববর্তী কালচক্রগুলি অসংখ্য তীর্থংকরের আবির্ভাব ঘটেছিল।[6] বর্তমান কালচক্র অর্থাৎ "হুন্দ অবসর্পিণী" যুগের প্রথম তীর্থংকর ছিলেন ঋষভনাথ। বলা হয়, তিনিই প্রথম মানুষকে সুশৃঙ্খলভাবে এক সমাজে বাস করার জন্য সূত্রবদ্ধ করে সংগঠিত করেন। এই কালচক্রার্ধের চব্বিশতম তথা শেষ তীর্থংকর ছিলেন মহাবীর (খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯-৫২৭ অব্দ)।[7][8][9] ইতিহাসবিদেরা মহাবীর ও তাঁর পূর্বসূরি তথা তেইশতম তীর্থংকর পার্শ্বনাথকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করেন।[10]
তীর্থংকর কৃচ্ছব্রতী ও কৃচ্ছব্রতিনী এবং "শ্রাবক" (গৃহস্থ অনুগামী) ও "শ্রাবিকা"দের (গৃহস্থ অনুগামিনী) নিয়ে "সংঘ" নামক চতুর্মুখী সংগঠনকে সংগঠিত করেন।[11]
তীর্থংকরদের শিক্ষা জৈনদের প্রামাণ্য ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তি গঠন করে। মনে করা হয়, তীর্থংকরদের আন্তর জ্ঞান হল ত্রুটিমুক্ত ও প্রত্যেক বিষয়েই অভিন্ন এবং তাঁদের শিক্ষাও একে-অপরের শিক্ষা থেকে ভিন্ন নয়। সেই শিক্ষার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যে ভিন্নতা দেখা যায়, তা তাঁদের নেতৃত্বকালীন যুগে সমাজের আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ও শুদ্ধতার উপর নির্ভর করে। সমাজের মনের আধ্যাত্মিক অগ্রগতি ও শুদ্ধতা যত বেশি হবে ততই বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজনও কমে আসবে।
তীর্থংকরদের কথা জৈনরা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের সম্মান করেন; অন্যদিকে তীর্থংকরদের করুণা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সকলের উপর বর্ষিত হয় বলেই কথিত হয়।[12]
তীর্থংকরেরা হলেন "অরিহন্ত", যাঁরা "কেবলজ্ঞান" (বিশুদ্ধ অনন্ত জ্ঞান) অর্জনের পর[13] ধর্ম শিক্ষা দিতেন। অরিহন্তকে "জিন" (বিজয়ী) নামেও অভিহিত করা হয়; শব্দটির অর্থ "যিনি ক্রোধ, আসক্তি, অহংকার ও লোভ প্রভৃতি আভ্যন্তরিণ শত্রুদের জয় করেছেন"।[4] তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের আত্মার রাজ্যে বাস করেন এবং "কাষায়", মানসিক আবেগ ও ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকেন। এর ফলে অনন্ত "সিদ্ধি" বা আধ্যাত্মিক শক্তি সহজেই তাঁরা প্রাপ্ত হয়, যা তাঁরা ব্যবহার করেন জীবিত সত্তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য। "দর্শন" (দিব্যদর্শন) ও "দেশনা"র (দিব্যবাক্য) মাধ্যমে তাঁরা একনিষ্ঠ অধ্যাত্ম-অনুসন্ধিৎসুদের কেবলজ্ঞান ও মোক্ষ (পরামুক্তি) অর্জনে সাহায্য করেন।