হুসাইন আহমদ মাদানি
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, দার্শনিক, লেখক ও ইসলামি পণ্ডিত / From Wikipedia, the free encyclopedia
হুসাইন আহমদ মাদানি (উর্দু: حسین احمد مدنی; ৬ অক্টোবর ১৮৭৯ — ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ; ১৯ শাওয়াল ১২৯৬ — ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৩৭৭ হিজরি) ছিলেন উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ভারতের অন্যতম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, সুফি, লেখক ও ইসলামি পণ্ডিত। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, খিলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন।[1] ১৯২০ সালে কংগ্রেস-খিলাফত জোট তৈরিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভারতীয় উলামা ও কংগ্রেসের যৌথ আন্দোলনের পথটি তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন ১৯২০ – ১৯৩০ সাল জুড়ে তার বক্তৃতা ও পুস্তক প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি ভারত ভাগ, দ্বিজাতি তত্ত্বের বিপক্ষে ছিলেন এবং সংযুক্ত ভারতের অভ্যন্তরে সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন।[2][3][4] রাষ্ট্র গঠনের জন্য আঞ্চলিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।[5] তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি এবং দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিস ছিলেন। তার সময়কালে দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাক্রম আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তিনি দেওবন্দ আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সমাদৃত। ইসলামি শাস্ত্রে তার পাণ্ডিত্য ও অবদানের জন্য তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে।[6] ভারতের এই তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় যাদেরকে প্রথম ভূষিত করা হয়েছিল তিনি তাদের অন্যতম। ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট ভারতীয় ডাক বিভাগ তার সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিট বের করেছে।
হুসাইন আহমদ মাদানি | |
---|---|
حسین احمد مدنی | |
৫ম সদরুল মুদাররিস, দারুল উলুম দেওবন্দ | |
কাজের মেয়াদ ১৯২৭ – ২৫ আগস্ট ১৯৫৭ | |
পূর্বসূরী | আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি |
উত্তরসূরী |
|
৩য় সভাপতি, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ | |
কাজের মেয়াদ ১৯৩৮ – ১৯৫৭ | |
পূর্বসূরী | কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি |
উত্তরসূরী | আহমদ সাইদ দেহলভী |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | (১৮৭৯-১০-০৬)৬ অক্টোবর ১৮৭৯ বাঙ্গারমৌ, উন্নাও জেলা, উত্তরপ্রদেশ, ভারত |
মৃত্যু | ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭(1957-12-05) (বয়স ৭৮) দেওবন্দ, সাহারানপুর জেলা, উত্তরপ্রদেশ, ভারত |
সমাধিস্থল | মাজারে কাসেমি |
জাতীয়তা |
|
রাজনৈতিক দল | জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ |
অন্যান্য রাজনৈতিক দল | |
দাম্পত্য সঙ্গী | ৪ |
সন্তান | ১৩; আসআদ মাদানি ও আরশাদ মাদানি সহ |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | দারুল উলুম দেওবন্দ |
পুরস্কার | পদ্মভূষণ (১৯৫৪) |
স্বাক্ষর | |
ওয়েবসাইট | madani.org |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
পিতামাতা |
|
আখ্যা | সুন্নি |
বংশ | সৈয়দ |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
আন্দোলন | দেওবন্দি |
প্রধান আগ্রহ | |
উল্লেখযোগ্য ধারণা | সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ |
উল্লেখযোগ্য কাজ |
|
তরিকা | চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া |
অন্য নাম | চেরাগে মুহাম্মদ (স.) |
আত্মীয় |
|
ঊর্ধ্বতন পদ | |
এর শিষ্য | |
শিষ্য | |
যার দ্বারা প্রভাবিত | |
যাদের প্রভাবিত করেন | |
তিনি ১৮৭৯ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৮৯২ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। মাহমুদ হাসান দেওবন্দির তত্ত্বাবধানে তিনি ইসলামি শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ১৮৯৯ সালে তিনি মদিনা চলে যান এবং মসজিদে নববীতে অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেন। মসজিদে নববীতে তিনি ১৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন যার কারণে তাকে ‘শায়খুল হারাম’ বলা হয়। ১৯১৫ সালে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মদিনায় আগমন করলে তিনিও তার সাথে যোগ দেন। ১৯১৬ সালে মক্কার শরিফ হুসাইন বিন আলির বিদ্রোহের কারণে হেজাজের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলে দেওবন্দি গ্রেফতার হয়ে মাল্টায় নির্বাসিত হন। দেওবন্দির বার্ধক্যের কথা চিন্তা করে মাদানি তার সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। প্রথমবারের বন্দি জীবনে তিনি দেওবন্দির সান্নিধ্যে থেকে তার চিন্তাধারা ও রাজনীতি গভীরভাবে আত্মস্থ করেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি করেন। ১৯২০ সালে মুক্তি লাভের পর তিনি দেওবন্দির সাথে ভারতে চলে আসেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। এর ছয় মাস পর দেওবন্দি মৃত্যুবরণ করলে তিনি দেওবন্দির উত্তরসূরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, এ কারণে তাকে ‘জানাশীনে শায়খুল হিন্দ’ বলা হয়। ১৯২০ সালে কলকাতায় আবুল কালাম আজাদ নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে দেওবন্দির নির্দেশে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং এখান থেকেই তার পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় খেলাফত সম্মেলনে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করা হারাম ঘোষণা করেন। ফতোয়াটি একইসাথে মুদ্রিত হয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলে তিনি দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার হন এবং দুই বছর পর ১৯২৩ সালে মুক্তি পান। এরপর তিনি সিলেটে চলে এসে শিক্ষাদীক্ষায় নিয়োজিত হন। তিন বছর পর ১৯২৭ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান এবং সদরুল মুদাররিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপিত হলে তিনি এতে সমর্থন করেন। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৩২ সালে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে কংগ্রেস ও জমিয়ত বেআইনি ঘোষিত হয়। তাই জমিয়ত কার্যনির্বাহী পরিষদ বাতিল করে একটি ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে যেখানে তিনি তৃতীয় সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। একারণে ১৯৩২ সালে তিনি তৃতীয়বারের মত গ্রেফতার হন। ১৯৩৬ সালের নির্বাচন উপলক্ষে তার সাথে মুসলিম লীগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সাথে বৈঠকের পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য জমিয়তের ২০ জন সহ মোট ৫৮ জন নিয়ে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম লীগ ভালো ফলাফল করলেও সারাদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে উভয় দলের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে চলে যায়। মুসলিম লীগও জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এ কারণে তার সাথে মুসলিম লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হলে তিনি পার্লামেন্টারি বোর্ড থেকে ইস্তফা দেন এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি ভারত বিভাজনকে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র মনে করতেন। এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ সমর্থিত পত্রিকাগুলোর বিরূপ প্রচারণার কারণে তাকে কাফের ফতোয়াও দেওয়া হয়। এসময় আল্লামা ইকবাল তাকে বিদ্রূপ করে কবিতা প্রকাশ করলে একটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়, ইতিহাসে যা মাদানি–ইকবাল বিতর্ক নামে পরিচিত।[7] নানামুখী সমালোচনার জবাবে ১৯৩৮ সালে তিনি তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের তৃতীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের সাহায্য করা হারাম ঘোষণা করে তিনি চতুর্থবারের মত গ্রেফতার হন এবং ২ বছর ২ মাস পর ১৯৪৪ সালে মুক্তি পান। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে তাকে সভাপতি করে ‘মুসলিম পার্লামেন্টারি বোর্ড’ গঠন করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচন-উত্তর ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশনের সাথে স্বাধীনতার রূপরেখা ও পদ্ধতি আলােচনায় জমিয়তের পক্ষ থেকে ‘মাদানি ফর্মুলা’ পেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির কাছ থেকে চার তরিকার খেলাফত পেয়েছিলেন। তার লক্ষাধিক মুরিদ ছিল, তন্মধ্যে ১৬৭ জনকে তিনি নিজের খলিফা বা উত্তরসূরি মনোনীত করেছিলেন। তিনি নকশে হায়াত, হামারা হিন্দুস্তান আওর উসকে ফাজায়েল, আশ শিহাবুস সাকিব সহ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে মাজারে কাসেমিতে দাফন করা হয়। ২০১৯ সালে সিলেটে তার স্মৃতি বিজড়িত স্থানে মাদানি চত্বর নির্মিত হয়েছে।