বিবর্তনবাদের ইতিহাস
ইতিহাসের বিভিন্ন দিক / From Wikipedia, the free encyclopedia
বিবর্তন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার শিকড় রয়েছে অনাদিকালেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটে – এই ধারণার সূত্র পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিস, রোম, চীন এবং মধ্যযুগের ইসলামী বিজ্ঞানে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে জীববিজ্ঞানে ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার উদ্ভবের পরে দুটি পরস্পরবিরোধী মতবাদ পাশ্চাত্ত্য জীববিজ্ঞান চিন্তাভাবনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রথমটি হল এসেন্সিয়ালিজম বা ‘অপরিহার্য্যবাদ’, এই মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রজাতির কিছু অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য থাকে যা অপরিবর্তনীয়। এই মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল মধ্যযুগীয় এরিস্টটল-অনুসারী অধিবিদ্যা থেকে, যা কিনা প্রাকৃতিক থিওলজি বা ধর্মবিদ্যার সঙ্গে খাপ খেয়ে যেত। দ্বিতীয় মতবাদটি ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের, ইউরোপের আলোকিত যুগে প্রাকৃতিক ইতিহাস, পদার্থ বিজ্ঞান এবং বিশ্বতত্ত্বের প্রসারের সঙ্গে যার উৎপত্তি। এই সময়েই প্রকৃতিবিদরা প্রজাতির বিভিন্নতা সম্বন্ধে সচেতন হলেন; জীবাশ্মবিজ্ঞানের প্রসারের ফলে জানা গেল প্রজাতির বিলুপ্তি সম্ভব, যা কিনা প্রকৃতির নিত্যতার ধারণার বিপরীত। ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসী প্রকৃতিবিদ জঁ-বাতিস্ত লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) ট্রান্সমিউটেশন অফ স্পিসিস বা ‘রূপান্তরবাদ’ তত্ত্বের অবতারণা করেন, এই তত্ত্বই ছিল বিবর্তন সম্পর্কিত প্রথম একটা সম্পূর্ণ তত্ত্ব।
১৮৫৮ সালে চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এক নতুন বিবর্তনের তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেন, বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয় ডারউইনের অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস (১৮৫৯) বইতে। লামার্কের বিপরীতে গিয়ে তারা বলেন ‘কমন ডিসেন্ট’ আর জীবনবৃক্ষের শাখাবিন্যাসের কথা, তার অর্থ হল জীবনবৃক্ষের শাখা ধরে উপরের দিকে উঠলে যেকোনও দুটি ভিন্ন প্রজাতিরই কোনো একটি সাধারণ উৎপত্তিস্থল পাওয়া সম্ভব। ডারউইন-ওয়ালেস তত্ত্বের মূল বিষয় ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া; পশুপালন, জীবভূগোল, ভূতত্ত্ব, অঙ্গসংস্থান ও ভ্রূণবিদ্যা র বিস্তৃত পরিসর থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রামাণিক তথ্য সংশ্লেষ করে এই তত্ত্ব নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এই তত্ত্ব নিয়ে তুমুল বিতর্কের বাতাবরণে বিবর্তনের সাধারণ ধারণাটা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে পড়ে, যদিও বিবর্তনের পদ্ধতি হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বীকৃতি এসেছে অনেক দেরিতে, ১৯২০-১৯৪০ সালের মধ্যে জীববিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতির পরে। এর মাঝের সময়ে, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ (নব্য-লামার্কবাদ), আভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তির প্রভাব (অর্থোজেনেসিস), আকস্মিক পরিব্যক্তি (স্যালটেশন), ইত্যাদি একাধিক বিকল্প মতবাদের চাপে ডারউইনের তত্ত্ব প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। এই ১৮৮০-১৯২০ সালের মধ্যের সময়টাকে ডারউইনের তত্ত্বের গ্রহণকাল বলে উল্লেখ করা হয়।[2] মটরশুঁটি নিয়ে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল এর ঊনবিংশ শতকে করা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পুনরাবিষ্কৃত হয় ১৯০০ সালে, আর ১৯১০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে রোনাল্ড ফিশার, জে বি এস হ্যালডেন, সিউয়েল রাইট প্রমুখ বিজ্ঞানীরা এই ফলাফলকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত করে একটা সম্পূর্ণ নতুন বিষয়, পপুলেশন জেনেটিক্স, এর গোড়াপত্তন করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে এই পপুলেশন জেনেটিক্স বিদ্যা জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিবর্তনের একটা সর্বব্যাপী তত্ত্ব খাড়া করে, যাকে বর্তমানে বলা হয় আধুনিক বিবর্তনিক সংশ্লেষণ।
বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এর প্রতিষ্ঠা, প্রাকৃতিক জনগোষ্ঠীতে পরিব্যক্তি এবং জিনগত বৈচিত্র্যের জ্ঞান, তার সঙ্গে জীবভূগোল ও সিস্টেমেটিক্স এর মিলিত সমন্বয়ে বিবর্তনের উন্নত গাণিতিক মডেল তৈরী হয়। জীবাশ্মবিজ্ঞান ও তুলনামূলক শারীরসংস্থানবিদ্যার প্রয়োগে জীবনের বিবর্তনের ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ এর দশকে আণবিক জিনতত্ত্ব র উদ্ভবের সঙ্গে প্রোটিনের অনুক্রম এবং রোগপ্রতিরোধশক্তির অনুপুঙ্খ পাঠের ফলে নতুন অধ্যয়ন ক্ষেত্র ‘মলিকিউলার ইভোলিউশন’ বা আণবিক বিবর্তনের উদ্ভব হয়, পর্বতীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরএনএ এবং ডিএনএ চর্চা। ১৯৬০ এর দশকে চর্চার কেন্দ্রে আসে বিবর্তনের জিন-কেন্দ্রিক দর্শন আর আণবিক বিবর্তনের ‘নিউট্রাল থিওরি’ বা নিরপেক্ষতা তত্ত্ব। বিতর্ক দানা বাঁধে অভিযোজন আর ‘ইউনিট অফ সিলেকশন’ বা নির্বাচনের একক নিয়ে। বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর ‘জেনেটিক ড্রিফট’ এর তুলনামূলক গুরুত্ত্ব নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরী হয়।[3] বিংশ শতকের শেষের দিকে ‘ডিএনএ সিকোয়েন্সিং’, আর তা থেকে ‘মলিকিউলার ফাইলোজেনেটিক্স’ এর উদ্ভব হয়, মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল উইস এর ত্রি-ডোমেইন তন্ত্রে জীবনবৃক্ষের ধারণা নতুন করে স্বীকৃত হয়। এছাড়াও নতুন উপলব্ধ জ্ঞান, ‘সিমবায়োজেনেসিস’ এবং অনুভূমিক জিন স্থানান্তর, বিবর্তনের তত্ত্বে আরও জটিলতার আমদানি করে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের উত্থান যে শুধু জীববিজ্ঞানের চিরাচরিত শাখাগুলিকেই সমৃদ্ধ করেছিল তাই নয়, অন্যান্য অধ্যয়ন ক্ষেত্রে (যেমন: নৃতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইত্যাদি) এবং বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব অপরিসীম।[4]