বিবর্তন
প্রজন্ম পর প্রজন্ম ধরে জৈবিক বংশগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন / From Wikipedia, the free encyclopedia
বিবর্তন বা অভিব্যক্তি হলো এমন একটি জীববৈজ্ঞানিক ধারণা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বুঝায়।[1][2] কোনো জীবের বংশধরদের মাঝে যে জিনরাশি ছড়িয়ে পড়ে তারাই বংশপ্রবাহে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদিও একটি প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা খুবই সামান্য। কিন্তু কালক্রমে জীবগোষ্ঠীতে সেই পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য হয়ে দেখা দেয় এবং এমনকি একসময় তা নতুন প্রজাতির উদ্ভবেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।[3] বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার দৃশ্যমান বিভিন্ন অঙ্গসাংস্থানিক ও জিনগত সাদৃশ্যগুলো একটা ধারণা দেয় যে আমাদের পরিচিত সকল প্রজাতির প্রাণীই এক ধারাক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি "সাধারণ পূর্বপুরুষ" থেকে ধীরে ধীরে উৎপত্তি লাভ করেছে।[4]
বিবর্তনের ভিত্তি হচ্ছে বংশপরম্পরায় জিনের সঞ্চারণ। যা একটি জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য দায়ী, তা-ই জিন। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য বা প্রকরণ সৃষ্টি হয়। বিবর্তন মূলত দুটি বিপরীত নিয়ামকের ফল : একটি প্রক্রিয়ায় ক্রমাগতভাবে নতুন প্রকরণ সৃষ্টি হয়, আর অন্যটির প্রভাবে এই প্রকরণগুলোর কোনো কোনোটির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং কোনো কোনোটির সংখ্যা হ্রাস পায়। নতুন প্রকরণ উৎপন্ন হয় দুটি প্রধান উপায়ে : ১. জিনগত মিউটেশন বা পরিব্যক্তির মাধ্যমে এবং ২. বিভিন্ন জীবগোষ্ঠী বা প্রজাতির মধ্যে জিনের স্থানান্তরের মাধ্যমে। "জিনেটিক রিকম্বিনেশনের" মাধ্যমেও নতুন বৈশিষ্ট্যসূচক জিন তৈরি হয় যা জীবগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রকরণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
দুটি প্রধান মেকানিজম বা করণকৌশল নির্ধারণ করে কোন একটি ভ্যারিয়্যান্টের সংখ্যা বাড়বে কী কমবে। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন, যে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে একদিকে একটি জীবগোষ্ঠীর অস্তিত্বের অনুকূল বৈশিষ্ট্যের (যে বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো একটি জীবের অধিককাল ধরে বেঁচে থাকা এবং সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে) অধিকারী সদস্য বা মভ্যারিয়্যান্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও কালক্রমে তা ঐ জীবগোষ্ঠীর কমন বা সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় এবং অন্যদিকে ক্ষতিকর বা কম সুবিধাদায়ক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভ্যারিয়্যান্টদের সংখ্যা হ্রাস করে, ফলে সেই ভ্যারিয়্যান্টগুলো ধীরে ধীরে বিরল হয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাপেক্ষে সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সদস্যগুলো অধিককাল বেঁচে থাকে এবং অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে পারে। ফলে বংশপরম্পরায় সেই বৈশিষ্ট্যগুলো বংশগতভাবে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে বেশি পরিমাণে সঞ্চারিত হয়।[4][5] প্রজন্মান্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ছোট ছোট র্যান্ডম বা দৈব পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমান্বয়ে জীবগোষ্ঠীতে প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং এভাবে সেই জীবগোষ্ঠী তার পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়।[6] বিবর্তনের আরেকটি প্রধান করণকৌশল হচ্ছে "জেনেটিক ড্রিফট", যে স্বাধীন পদ্ধতিতে গোষ্ঠীস্থিত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতির হার বা ফ্রিকোয়েন্সি অব ট্রেইটস দৈবাৎ পরিবর্তিত হয়।
বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে বিবর্তন সংঘটিত হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিবর্তনকে ব্যাখ্যাকারী তত্ত্বগুলোকে তারা যাচাই করে দেখেছেন, এগুলোর উন্নয়ন সাধন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয়েছিল যখন ফসিল রেকর্ড আর প্রাণীবৈচিত্র্যের ভিত্তিতে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সময়ের সাথে সাথে জীব প্রজাতি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে।[7][8] তবে বিবর্তন সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অস্পষ্ট বা বলতে গেলে অজানাই রয়ে যায় যতদিন না চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস পৃথক পৃথকভাবে তাদের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস-এর মাধ্যমে ডারউইন যখন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রচার করলেন, তখনই তা বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সর্বসাধারণ কর্তৃক সমাদৃত হয়।[9][10][11][12][13] তারও অনেক পরে, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সাথে মেন্ডেলীয় বংশগতিবিদ্যার মেলবন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণী তত্ত্ব বা মডার্ন এভুলিউশনারি সিনথেসিস, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন ও মেন্ডেলীয় জেনেটিক্সের সাহায্যে সমন্বিতভাবে বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে।[14]
মানবজাতি সহ পৃথিবীর সমস্ত জীবনের একটি শেষ সর্বজনীন সাধারণ পূর্বপুরুষ (LUCA) ছিল ,[15][16][17] যা প্রায় ৩.৫ থেকে ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বসবাস করতো। [18] জীবাশ্ম রেকর্ডে প্রাথমিক বায়োজেনিক গ্রাফাইট[19] থেকে মাইক্রোবায়াল ম্যাট জীবাশ্ম.[20][21][22] এবং তা থেকে জীবাশ্মে পরিণত বহুকোষী জীবের অগ্রগতি দেখা যায়। জীববৈচিত্র্যের বিদ্যমান নিদর্শনগুলো পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনীয় ইতিহাস জুড়ে বারবার নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন (প্রজাত্যায়ন), প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন (এনাজেনেসিস) এবং প্রজাতি হ্রাসের (বিলুপ্তি) মাধ্যমে আকৃতি লাভ করেছে। [23] সাম্প্রতিক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত প্রজাতিগুলোর অঙ্গসংস্থানিক এবং জৈব রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ । এ বৈশিষ্ট্যগুলো ফাইলোজেনেটিক গাছ পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।[24][25]
বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা ক্ষেত্র বা পরীক্ষাগার থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এবং গাণিতিক জীববিজ্ঞানের পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্তগুলির উপর ভিত্তি করে তত্ত্ব এবং অনুকল্প গঠন এবং পরীক্ষা করে বিবর্তনের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন অব্যাহত রেখেছেন। তাদের আবিষ্কারগুলো কেবল জীববিজ্ঞানের বিকাশকেই প্রভাবিত করেনি বরং কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান সহ আরও অনেক বৈজ্ঞানিক ও শিল্প ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে।[26]