পঠন
লিখিত প্রতীক বিসংকেতায়িত করে অর্থ বের করার সংজ্ঞানাত্মক প্রক্রিয়া / From Wikipedia, the free encyclopedia
পঠন বা পড়া বলতে কোনও নির্দিষ্ট ভাষায় লিখিত বা মুদ্রিত বর্ণ, বিরামচিহ্ন, শব্দ, বাক্য, ইত্যাদি দিয়ে গঠিত কোনও পাঠ্যবস্তু বা বার্তা থেকে তথ্য আহরণের উদ্দেশ্যে চোখ দিয়ে দেখে মনের ভেতরে প্রক্রিয়াজাত করে সেগুলির অর্থ অনুধাবন করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। তবে অন্ধ ব্যক্তিরা বিশেষ উপায়ে মুদ্রিত পাঠ্যবস্তু স্পর্শের মাধ্যমেও পড়তে পারে।[2][3][4][5]
পঠন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দৃশ্য লিখিত রূপ থেকে মনের ভেতরে অর্থের উপলব্ধি হয়, তা নিয়ে মতভেদ আছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে পাঠক পড়ার সময় মনে মনে নিঃশব্দে পাঠ্যটি উচ্চারণ করে নেয়, অর্থাৎ এক ধরনের মানসিক শ্রবণ ঘটে এবং এর পরে সেটির অর্থ মনে প্রক্রিয়াজাত হয়। আবার অন্য কিছু বিশেষজ্ঞের মতে দৃশ্য রূপটির কোনও ধ্বনিগত প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যতিরেকেই সরাসরি মনের মধ্যে অর্থ উৎপন্ন হয়। মানুষ নিঃশব্দে পড়ার সময়েও যে ধ্বনিগত উচ্চারণের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের কাছে পঠন হল একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া যার সাথে শব্দ শনাক্তকরণ, বানান পদ্ধতি, বর্ণমালা, বর্ণ ও ধ্বনির সম্পর্ক, ধ্বনিমূল সচেতনতা, শব্দভাণ্ডার, মর্মগ্রহণ, সাবলীলতা ও প্রেষণা, ইত্যাদি ব্যাপারগুলি জড়িত।[6][7]
পঠন হল পাঠক ও পাঠ্যবস্তুর মধ্যে একান্তে, মনের অভ্যন্তরে, সাধারণত নিঃশব্দে সংঘটিত একট আন্তঃক্রিয়ামূলক ঘটনা বা প্রক্রিয়া। পঠনের সময় পাঠক একাধিক উত্তরোত্তর সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রথম পর্যায়ে একজন সাক্ষর পাঠক বিসংকেতায়ক হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ লিখিত বা মুদ্রিত পাঠ্যবস্তুর চিহ্নগুলি কী করে ধ্বনি, ধ্বনিদল (সিলেবল), শব্দ, বাক্য, ইত্যাদি গঠন করেছে, তা মনের ভেতরে নিহিত ঐ ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপমূলতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, বাগর্থতত্ত্ব, শব্দভাণ্ডার ইত্যাদির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে অনুধাবন করতে পারে (পঠনের নিম্ন-থেকে-ঊর্ধ্বগাম প্রতিমান bottom-to-top model)। বিসংকেতায়নের কাজটি যত স্বয়ংক্রিয় হয়, পাঠ্যবস্তুর মর্ম অনুধাবন ও পাঠ্যবস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়া সম্পাদন করার সময় তত বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে একজন পাঠক শুধু লিখিত সংকেত থেকেই অর্থ বের করে না, বরং সে একই সময়ে কী পড়ছে, তার কাছে এর অর্থ কী, তার ইতিমধ্যে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সাথে এর কী সম্পর্ক, ভবিষ্যতে কী পড়ার সম্ভাবনা আছে - এ ব্যাপারগুলি নিয়েও সক্রিয়ভাবে চিন্তা করে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পাঠক একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী (পঠনের ঊর্ধ্ব-থেকে-নিম্নগামী প্রতিমান top-to-bottom model)। তৃতীয় পর্যায়ের পাঠক একজন ব্যবহারকারী হয়ে ওঠে; সে পাঠ্যবস্তুর বিভিন্ন বর্গ বা প্রকারভেদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে, কল্পকাহিনী ও নকাল্পনিক রচনা, ক্রিয়ামূলক বা নান্দনিক পাঠ্য নিয়ে কাজ করে, কোনও সামাজিক পরিস্থিতে কোন উদ্দেশ্যে কী পাঠ্যবস্তু পড়তে হবে, তা বাছাই করার সামর্থ্য রাখে। সর্বশেষ ও চতুর্থ পর্যায়ের পাঠক হল একজন বিশ্লেষক; সে কঠোর সমালোচনার দৃষ্টিতে পাঠ করে এবং কোনও পাঠ্য কোন ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে, কেন সেভাবে লেখা হয়েছে, এতে কার লাভ বা ক্ষতি, কোন তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা হয়নি, লেখকের মূল্যবোধ কী, ইত্যাদি বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখে। অর্থাৎ পঠন প্রক্রিয়াটি সদা চলমান ও পরিবর্তনশীল এবং একই পাঠ্যবস্তু একই পাঠক ভিন্ন সময়ে বা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে পড়লে পঠন প্রক্রিয়াটিও ভিন্ন হয়। আবার একই পাঠ্যবস্তুর পঠন ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের জন্য ভিন্ন হয়। প্রতিটি পাঠ্যবস্তুর একট "আর্থিক সম্ভাবনা" (Meaning potential) থাকে, যা পঠনের মাধ্যমে পাঠকের মনে একটি অন্তিম রূপ ধারণ করে। পঠনের কিছু কিছু তত্ত্বে পঠনের প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, আবার অন্য কিছু তত্ত্বের পঠনের ফলাফল বা উৎপাদের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পঠনের ফলাফল নিয়ে গবেষণা করা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও এতে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পঠনের প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য সম্পর্কে তেমন জানা যায় না।