রাজা দাউদ
একজন নবী ও ইসরাইল এবং ইহুদি রাজ্যের রাজা / From Wikipedia, the free encyclopedia
দাউদ (হিব্রু ভাষায়: דָּוִד, Dāwīḏ; আরবি: دَاؤُوْد, প্রতিবর্ণীকৃত: Dāwūd; প্রাচীন গ্রিক: Δαυίδ, Dauíd; লাতিন: Davidus; গিইজ: ዳዊት, Dawit; প্রাচীন আর্মেনীয়: Դաւիթ, Dawitʿ; গির্জা স্লাভোনীয়: Давíдъ, Davidŭ)[5] ছিলেন হিব্রু বাইবেল অনুসারে সংযুক্ত ইস্রায়েল ও যিহূদা রাজ্যের রাজা[6][7] এবং বাইবেলের নূতন নিয়ম অনুসারে গালাতীয়দের প্রতি পত্র ও সাধু লূক লিখিত সুসমাচার মতে যীশুর পুর্বপুরুষ যাকোবের পুত্র, যিহূদার অধস্তন বংশধর। তাঁর পিতার নাম যিশিয়। অনেক পুত্র সন্তানের মধ্যে দায়ূদ ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। বাইবেলের বিবরণে ডেভিড বা দায়ূদ একজন অল্প বয়সী মেষপালক ছিলেন, যিনি প্রথম একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং গলিয়াত দ্বারা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রাজা শৌলের প্রিয় ছিলেন এবং শৌলের ছেলে যোনাথনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন।
দায়ূদ דָּוִד دَاؤُوْد Δαυίδ Davidus ዳዊት Դաւիթ Давíдъ | |
---|---|
রাজা ভাববাদী | |
ইস্রায়েলীয় রাজা | |
রাজত্ব | আনু. ১০১০–৯৭০ খ্রি.পূ.[lower-alpha 1] |
পূর্বসূরি | ঈশ্বোশৎ[3][4] |
উত্তরসূরি | শলোমন |
সঙ্গী | ৮ স্ত্রী:
|
বংশধর | ১৮+ সন্তান:
|
প্রাসাদ | দায়ূদের বংশ |
পিতা | যিশয় |
মাতা | নিশবৎ (তালমুদ) |
দাউদ বনী ইসরাঈলের দ্বাদশ গোত্রের মধ্যে ইয়াহুদার বংশের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রা.) ওহাব ইবনে মুনাব্বেহ-এর মাধ্যমে দাউদের চেহারা/গঠনের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বেটে,ক্ষুদ্রাকৃতি,নীল চোখ, দেহে অতি অল্প পরিমাণ লোম ছিল। মুখের চেহারা থেকে অন্তরের পবিত্রতা দেখা যেত। দাউদের সাথে বনী ইসরাইলদের বন্ধুত্বের কারণে তালুতের পরেই তিনি শাসন ক্ষমতা পেয়ে যান। মহান আল্লাহ তাকে নবুয়তও প্রদান করেন। পূর্বে বনী ইসরাইলের এক বংশের কাছে ছিল শাসন ক্ষমতা আর অন্য বংশের কাছে ছিল নবুয়ত। দাউদ প্রথম দুটোই একসাথে পান। তিনি মহান আল্লাহর নবীও ছিলেন, আবার বাদশাহও ছিলেন। তিনি বনী ইসরাইলীদের সামাজিক ও সামগ্রিক জীবন দেখাশুনা করতেন। এই জন্য মহান আল্লাহ তাকে খলীফা হিসাবে আখ্যায়িত করলেন। দাউদ মুসার শরীয়তকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন।‘যাবুর’ কিতাবটি মহান আল্লাহর প্রশংসায় ভরপুর ছিল। দাউদের গলায় মহান আল্লাহ যাদুর সুর দান করেছিলেন যে, তেলাওয়াতের সময় মানুষ তো অবশ্যই পাখি,জীব-জন্তু পর্যন্ত অভিভূত হয়ে যেত।‘যাবুর’ শব্দের অর্থ পারা বা খন্ড। মহান আল্লাহর দয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি কম/বেশি যাই থাকুক না কেন, সাফল্য সবসময় তার পক্ষেই থাকতো। সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে তার সাম্রাজ্য সিরিয়া,ইরাক,ফিলিস্তিন এবং পূর্ব জর্ডানের সমস্ত এলাকা তার অধীনে এসে যায়।হেজাযের কিছু অংশ তার নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রজাদের তার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, যেকোন জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবার মত ক্ষমতা তার আছে।
বনু ইস্রাঈলগণের নিকটে একটা সিন্দুক ছিল। যার মধ্যে তাদের নবী মূসা, হারূন ও তাদের পরিবারের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল। তারা এটাকে খুবই বরকতময় মনে করত এবং যুদ্ধকালে একে সম্মুখে রাখত। একবার আমালেক্বাদের সাথে যুদ্ধের সময় বনু ইস্রাঈলগণ পরাজিত হলে আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত উক্ত সিন্দুকটি নিয়ে যায়। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়িতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়িতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়িটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্তুতি শুরু করলেন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাউদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর।"অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হতে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আঁজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হতেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন।" (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্তুতবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাউদ।"আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর।"( বাক্বারাহ ২/২৫০)
জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতি -পক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাউদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হলেন না। কিন্তু দাউদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাউদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাউদ পকেট থেকে পাথরখণ্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন।
দাউদ একজন দক্ষ কর্মকার ছিলেন। বিশেষ করে শত্রুর মোকাবিলার জন্য উন্নত মানের বর্ম নির্মাণে তিনি ছিলেন একজন কুশলী কারিগর। যা বিক্রি করে তিনি সংসার যাত্রা নির্বাহ করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের ভরণপোষণের জন্য কিছুই নিতেন না।
বনু ইস্রাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাউদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হতে ‘মস্খ’বা আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন " তোমরা তাদেরকে ভালরূপে জেনেছ, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি বলেছিলাম: তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও। অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ গ্রহণের উপাদান করে দিয়েছি।" (সুরা বাকারাহ-৬৫-৬৬)। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে যে, ইহুদীরা প্রথমে গোপনে ও বিভিন্ন কৌশলে এবং পরে ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ দিনে মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তারা দুদলে বিভক্ত হয়ে যায়। সৎ ও বিজ্ঞ লোকেরা একাজে বাধা দেন। অপরদল বাধা অমান্য করে মাছ ধরতে থাকে। ফলে প্রথম দলের লোকেরা শেষোক্তদের থেকে পৃথক হয়ে যান। তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এমনকি তাদের বাসস্থানও পৃথক করে নেন। একদিন তারা অবাধ্যদের এলাকায় চরম নীরবতা লক্ষ্য করেন। অতঃপর তারা সেখানে পৌঁছে দেখলেন যে, সবাই বানর ও শূকরে পরিণত হয়ে গেছে। ক্বাতাদাহ বলেন যে, বৃদ্ধরা শূকরে এবং যুবকেরা বানরে পরিণত হয়েছিল। রূপান্তরিত বানরেরা নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে চিনতে পেরেছিল এবং তাদের কাছে গিয়ে অঝোর নয়নে অশ্রু বিসর্জন করেছিল।
বাইবেলের পুরানো নিয়মে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) দাউদকে বলা হয়েছে সেন্ট লুইস ডেভিড। দাউদের মাজার এখনও আছে যা ইহুদীরা সংরক্ষণ করে রেখেছেন। সে মাজারের গেটে এখনও লেখা আছে 'কিং সেন্ট ডেভিড'।