মিশরীয় মন্দির
প্রাচীন মিশরে দেবদেবীদের প্রার্থনা ও ফারাওদের স্মরণের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপনাসমূহ / From Wikipedia, the free encyclopedia
মিশরীয় মন্দির নির্মিত হত দেবদেবীদের আনুষ্ঠানিক পূজানুষ্ঠান এবং প্রাচীন মিশর ও মিশরীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা অঞ্চলগুলির ফ্যারাওদের স্মৃতিরক্ষার্থে। যে দেবতা বা রাজার উদ্দেশ্যে মন্দিরগুলি উৎসর্গিত হত, সংশ্লিষ্ট মন্দিরটিকে সেই দেবতা বা রাজার বাসগৃহ মনে করা হত। মন্দিরের মধ্যে মিশরীয়রা বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। মিশরীয় ধর্মের মূল উদ্দেশ্য স্বরূপ এই সব আচারগুলির মধ্যে ছিল দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ, উৎসবের মাধ্যমে তাঁদের পৌরাণিক ভাববিনিময়ের পুনরাভিনয় এবং বিশৃঙ্খলার শক্তিগুলিকে অপসারণ-মূলক অনুষ্ঠানসমূহ। মনে করা হত যে, মাত অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য বিন্যাস রক্ষার নিমিত্ত দেবতাদের জন্যেও এই আচারগুলি প্রয়োজনীয়। দেবালয় নির্মাণ ও দেবতাদের পরিচর্যা ছিল ফ্যারাওদের অবশ্যকর্তব্য। তাই তাঁরা মন্দির নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রভূত সম্পদ দান করতেন। প্রয়োজনের খাতিরে ফ্যারাওরা পুরোহিতবৃন্দের প্রতি তাঁদের অধিকাংশ আচারগত কর্তব্যে প্রতিনিধিত্ব করতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হত না। এমনকি মন্দিরের পবিত্রতম অংশগুলিতে তাদের প্রবেশের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। তা সত্ত্বেও সকল শ্রেণির মিশরীয়ের কাছেই মন্দির ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। তারা সেখানে যেত সেখানে বসবাসকারী দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে, পূজা উৎসর্গ করতে এবং দৈববাণীমূলক সহায়তা অনুসন্ধান করতে।
মন্দিরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল গর্ভমন্দিরটি। সাধারণত এইখানে একটি কাল্ট-মূর্তি (মন্দিরের দেবতার মূর্তি) প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গর্ভমন্দিরের বাইরের কক্ষগুলি বৃহত্তর ও অধিকতর সজ্জাবহুল হতে শুরু করে। এর ফলে প্রাগৈতিহাসিক মিশরের (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ভাগ) ছোটো ছোটো পূজাস্থানগুলি বিবর্তিত হয়ে নতুন রাজ্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১০৭০ অব্দ) ও পরবর্তীকালের বৃহদাকার প্রস্তরনির্মিত অট্টালিকায় পরিণত হয়। এই সকল অট্টালিকাগুলি ছিল প্রাচীন মিশরীয় স্থাপত্যের বৃহত্তম এবং সর্বাপেক্ষা টেকসই উদাহরণগুলির অন্যতম। এগুলির উপাদানগুলিকে ধর্মীয় প্রতীকতত্ত্বের একটি জটিল নকশা দ্বারা বিন্যস্ত ও অলংকৃত করা হত। এই মন্দির নকশার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল প্রাচীরবেষ্টিত সভাকক্ষ, উন্মুক্ত দরবার এবং উৎসবের শোভাযাত্রার জন্য ব্যবহৃত পথের ধারে সারিবদ্ধ পাইলন শৈলীর প্রবেশপথ। মূল মন্দিরের বাইরে একটি বহিঃস্থ প্রাচীর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অপ্রধান ভবনগুলিকে বেষ্টিত করে রাখা হত।
একটি বৃহদাকার মন্দিরের বেশ বড়ো নিজস্ব জমি এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে সহস্রাধিক সাধারণ কর্মচারীও থাকত। এই কারণে ধর্মীয় কেন্দ্রের পাশাপাশি মন্দিরগুলি ছিল প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। যে পুরোহিতগণ এই সব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, তাঁরা যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন এবং বাহ্যত রাজার অধীনস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠতে পারতেন।
জাতির অবনতি এবং শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে রোমান সাম্রাজ্যের হাতে স্বাধীনতা হারানো সত্ত্বেও মিশরে মন্দির-নির্মাণের কাজে কোনও ছেদ পড়েনি। খ্রিস্টধর্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত মিশরীয় ধর্ম উত্তরোত্তর নিপীড়নের শিকার হতে থাকে এবং খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে সে দেশে মন্দির-কাল্টগুলি অবলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর পরিত্যক্ত মন্দিরগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধ্বংস ও অবহেলার সম্মুখীন হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপ ভাসিয়ে দিয়ে যায় প্রাচীন মিশর সম্পর্কে আগ্রহের একটি নতুন তরঙ্গ। এই সময়ই উৎপত্তি ঘটে মিশরতত্ত্ব নামক আকাদেমিক শাখাটির। এর পর প্রাচীন এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের প্রতি বহু সংখ্যক পর্যটক আকর্ষিত হন। বহু সংখ্যক প্রাচীন মন্দির মিশরে আজও রয়েছে। এগুলির কয়েকটি পরিণত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রে, যা আধুনিক মিশরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণভাবে অবদান রেখে চলেছে। মিশরতত্ত্ববিদগণ এখনও টিকে থাকা মন্দির ও ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাচীন মিশরীয় সমাজ সম্পর্কে তথ্যের বহুমূল্য উৎস হিসেবে।