মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের ইতিহাস
ইতিহাসের বিভিন্ন দিক / From Wikipedia, the free encyclopedia
মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের ইতিহাস বলতে মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের নথিবদ্ধ ইতিহাসকেই বোঝায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে প্রাচীন মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই গ্রহ পর্যবেক্ষণের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই নথিগুলি মঙ্গল পর্যবেক্ষণের আদিতম নথিপত্রের অন্যতম। চৌ রাজবংশের প্রতিষ্ঠারও (খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৫ অব্দ) আগে চীনা নথিপত্রে মঙ্গল গ্রহের গতিবিধির কথা উল্লিখিত হয়েছিল। ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের অবস্থান বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে গ্রহটি ভবিষ্যৎ অবস্থান গণনার পাটিগাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। গ্রিক দার্শনিক ও হেলেনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ভূকেন্দ্রিক মডেলের মাধ্যমে গ্রহটির গতিবিধি ব্যাখ্যা করতেন। প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় গ্রন্থগুলিতে মঙ্গল গ্রহের কৌণিক ব্যাসের পরিমাপগুলি পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলাস কোপারনিকাস সৌরজগতের যে সূর্যকেন্দ্রিক মডেলটি প্রস্তাব করেছিলেন তাতে তিনি গ্রহগুলিকে বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণরত বলে উল্লেখ করেন। জোহানেস কেপলার এই মডেলটিকে সংশোধন করে মঙ্গল গ্রহের একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা করেন, যা পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছিল।
১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম দূরবীন দ্বারা মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেন। এর এক শতাব্দীকালের মধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহটিতে স্বতন্ত্র অ্যালবেডো বৈশিষ্ট্যগুলি আবিষ্কার করেন, যার অন্যতম ছিল সার্টিস মেজর প্লেনাম নামক কালো ছোপটি এবং মেরুস্থ হিমছত্রগুলি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহটির আবর্তন কাল ও আক্ষিক আনতি নির্ধারণেও সক্ষম হন। এই পর্যবেক্ষণগুলি করা হয়েছিল যে সময় মঙ্গল সূর্যের বিপরীতে অবস্থান করার সময় পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিকটে আসে সেই সময়গুলিতে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নির্মিত উন্নততর দূরবীনগুলির দ্বারা মঙ্গল গ্রহের অ্যালবেডো বৈশিষ্ট্যগুলির মানচিত্র বিস্তারিতভাবে অঙ্কন করা সম্ভব হয়। মঙ্গল গ্রহের প্রথম খসড়া মানচিত্রটি প্রকাশিত হয় ১৮৪০ সালে। ১৮৭৭ সালের পর থেকে এই গ্রহের অধিকতর সংশোধিত মানচিত্রগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন ভুলক্রমে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে জলের বর্ণালিগত চিহ্ন শনাক্ত করেছেন বলে মনে করেন, তখন মঙ্গল গ্রহে জীবনের অস্তিত্বের ধারণাটি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পার্সিভাল লোয়েল বিশ্বাস করতেন যে, তিনি মঙ্গল গ্রহে কৃত্রিম খালের একটি সুসংবদ্ধ প্রণালী দেখতে পেয়েছেন।[1] পরবর্তী মঙ্গল গ্রহের এই বৈশিষ্ট্যগুলি দৃষ্টিভ্রম মাত্র প্রমাণিত হয় এবং জানা যায় যে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল একটি পৃথিবী-সদৃশ পরিবেশ ধারণের জন্য যথেষ্ট ঘনত্বসম্পন্ন নয়।
১৮৭০-এর দশক থেকে মঙ্গল গ্রহে হলুদ মেঘ দেখা যাচ্ছে। ইউজিন এম. অ্যান্টনিয়াডির মতে, এগুলি বায়ুতাড়িত বালি বা ধুলো। ১৯২০-এর দশকে মঙ্গল-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়; এই তাপমাত্রা ছিল −৮৫ থেকে ৭ °সে (−১২১ থেকে ৪৫ °ফা)। গ্রহটির বায়ুমণ্ডল শুষ্ক বলেই জানা যায়, যেখানে অক্সিজেন ও জল খুব অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে গেরার্ড কাইপার দেখিয়েছিলেন যে, মঙ্গল গ্রহের ঘনত্বহীন বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড রয়েছে; যার পরিমাণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রায় দ্বিগুণ। ১৯৬০ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক মঙ্গল গ্রহের অ্যালবেডো বৈশিষ্ট্যগুলির প্রথম প্রামাণ্য নামকরণ করা হয়। ১৯৬০-এর দশক থেকে প্রেরিত অনেকগুলি রোবট-চালিত মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথ ও পৃষ্ঠভাগ থেকে গ্রহটিতে অনুসন্ধান কার্য চালিয়ে আসছে। একটি বিস্তৃত তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালিতে পৃথিবী ও মহাকাশ-ভিত্তিক যন্ত্রপাতিগুলির দ্বারা গ্রহটিকে এখনও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মঙ্গল গ্রহে উৎপন্ন একটি উল্কাখণ্ড পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই গ্রহের রাসায়নিক অবস্থা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়েছে।