বায়বান্তরীক্ষ নির্মাতা
From Wikipedia, the free encyclopedia
বায়বান্তরীক্ষ শিল্প বলতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতরে উড্ডয়নক্ষম বিমান (বায়ুযান বা আকাশযান) এবং বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাকাশে উড্ডয়নক্ষম মহাকাশযান ও এগুলির যন্ত্রাংশ নকশাকরণ, নির্মাণ, পরীক্ষণ, নির্মাণ ও শিল্পোৎপাদন সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক শিল্পখাতটিকে নির্দেশ করা হয়। যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই শিল্পখাতে জড়িত, তাদেরকে বায়বান্তরীক্ষ নির্মাতা (Aerospace manufacturer) বলা হয়। ১৯৫০-এর দশকে প্রথম মহাকাশ যাত্রাগুলির আগ পর্যন্ত বায়বান্তরীক্ষ শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা "অ্যারোস্পেস"-এর তেমন প্রচলন ছিল না। সেসময় "অ্যারোনটিকস" (বায়ুযান বা বিমান চালনাবিদ্যা) ও "স্পেসফ্লাইট" (মহাকাশ বা অন্তরীক্ষ যাত্রা) - এই দুইটি পরিভাষার সমন্বয়ে এই নতুন পরিভাষাটি সৃষ্টি করা হয়। তবে ২০শ শতকের শুরু থেকেই প্রথম বিমানগুলির নির্মাণের ঘটনাগুলিতে এই শিল্পটির শেকড় প্রোথিত। আধুনিক বায়বান্তরীক্ষ শিল্পকে একটি উচ্চ প্রযুক্তির (হাই টেক) শিল্পখাত হিসেবে গণ্য করা হয়। বৃহত্তর বায়বান্তরীক্ষ শিল্পকে বিমান শিল্প ও মহাকাশ শিল্প - এই দুইটি শাখায় ভাগ করা যায়। বিমান শিল্প বেসামরিক বিমানচালনা ও সামরিক বিমানচালনা - উভয় খাতের জন্য বিমান ও বিমানের মেরামতি বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যন্ত্রাংশ নির্মাণ করে থাকে। আর মহাকাশ শিল্প পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাকাশ অনুসন্ধান ও ব্যবহারের জন্য প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের প্রণালীবদ্ধ প্রয়োগ ঘটায়।
বায়বান্তরীক্ষ শিল্পে উৎপন্ন যানবাহন ও দ্রব্যগুলির মধ্যে আছে ইঞ্জিনবিহীন বিমান (গ্লাইডার), মানবহীন আকাশযান (ড্রোন), বায়ু-অপেক্ষা-হালকা যান (যেমন বেলুন ও বায়ু-অপেক্ষা-হালকা উড়োজাহাজ), বায়ু-অপেক্ষা-ভারী আকাশযান (স্থির ডানাবিশিষ্ট বিমান ও ঘুরন্ত ডানাবিশিষ্ট হেলিকপ্টার), ক্ষেপণাস্ত্র, মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত যান (রকেট ইঞ্জিন), মানববাহী বা মানববিহীন মহাকাশযান, নভোখেয়াযান, কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশ সন্ধানী, কক্ষীয় বিরতিকেন্দ্র, ইত্যাদি। বিমানগুলি বেসামরিক প্রচালক-চালিত বা জেটচালিত বাণিজ্যিক মালামাল, যাত্রীবাহী ও আকাশক্রীড়ায় অংশগ্রহণকারী বিমান হতে পারে কিংবা অস্ত্রবাহী সামরিক বিমান হতে পারে। এগুলি ছাড়াও বায়বান্তরীক্ষ শিল্পটি উপরোল্লিখিত যানবাহনগুলির পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত উপব্যবস্থাগুলির শিল্পোৎপাদনের সাথেও জড়িত, যাদের মধ্যে সম্মুখ প্রচালক ব্যবস্থা (যেমন বৃহৎ বিমানকে চালনাকারী টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন), বৈদ্যুতিন বিমানচালনা ব্যবস্থা (এভিয়নিকস), বৈদ্যুতিন দূরনির্দেশনা, দিকনির্দেশনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত। অধিকন্তু উপরোল্লিখিত সমস্ত যান ও ব্যবস্থাগুলির পরীক্ষণ, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতি সেবার কারিগরদের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিশেষ সহায়তা প্রদানকারী হাতিয়ার-সরঞ্জাম-উপকরণাগুলিও এই শিল্পে উৎপাদন করা হয়। সরকারি সংস্থার দ্বারা জারিকৃত ধরন সনদপত্র (টাইপ সার্টিফিকেট) ও প্রতিরক্ষা আদর্শমান (ডিফেন্স স্ট্যান্ডার্ড) মান্য করে এইসব প্রযুক্তি নির্মাণ বা শিল্পোৎপাদন করা হয়। উপরন্তু, বায়বান্তরীক্ষ শিল্প-বহির্ভূত অনেক শিল্পের দ্রব্য ও ব্যবস্থাতেও এই শিল্পের কারিগরি কৌশল ও অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করা হয়, যা প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটি উদাহরণ।
বায়বান্তরীক্ষ প্রযুক্তিগুলি প্রতি একক ওজনের হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান। এগুলি অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির, কেননা এগুলিতে অসংখ্য জটিল যন্ত্রাংশ থাকে। তাই কোনও দেশের জন্য বায়বান্তরীক্ষ শিল্পের অধিকারী হওয়া আর্থ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই মর্যাদার বিষয়। উৎপাদিত সামগ্রীর আর্থিক মূল্য ও কর্মসংস্থানের নিরিখে বায়বান্তরীক্ষ শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পোৎপাদন খাতগুলির একটি, কিন্তু এতে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই খাতে ৫ লক্ষ ৩৪ হাজারের বেশি কর্মী যুক্ত ছিল।[1] বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতিসমৃদ্ধ দেশগুলি যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও প্রধান পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির (ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ইতালি) অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সেগুলির বায়বান্তরীক্ষ শিল্প। কিছু অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর অর্থনীতির দেশ যেমন ইসরায়েলের অর্থনীতিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বায়বান্তরীক্ষ শিল্পে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। ২০১৯ সালে দেশটি বিশ্ববাজারে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের বায়বান্তরীক্ষ পণ্য রপ্তানি করে। ২০১৯ সালে মার্কিন বায়বান্তরীক্ষ খাতের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশটির অন্য সব শিল্পোৎপাদন খাতের চেয়ে বেশি।[1] যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে বিশ্বের সেরা ২০টি বায়বান্তরীক্ষ শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ১৬টি অবস্থিত।[2] এদের মধ্যে ইউরোপের এয়ারবাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং, লকহিড মার্টিন, নরথ্রপ গ্রামেন, জেনারেল মোটর্স এভিয়েশন ও হানিওয়েল, ফ্রান্সের সাফ্রঁ, যুক্তরাজ্যের এলথ্রিহ্যারিস ও রোলস রয়েস হোল্ডিংস বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি কোম্পানি।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বায়বান্তরীক্ষ শিল্পের প্রায় প্রতিটি স্তরেই ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিদ্যমান। বেশির ভাগ উন্নত দেশের একটি বিমান শিল্প ছিল এবং নির্দিষ্ট কোনও দেশের বিমান নির্মাণ শিল্প কোনও বিশেষ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য কৃতিত্বের দাবিদার হলেও এই অগ্রগতি খুব শীঘ্রই বাকি দেশগুলিতে ছড়িয়ে যেত। বর্তমানে বায়বান্তরীক্ষ শিল্প বহু দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ-দক্ষতার কর্মসংস্থানের যোগান দেয়, প্রযুক্তিগত নব্যতাপ্রবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে এবং যোগানদাতা ও সেবা প্রদায়কদের এক বিশাল জালিকাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু শিল্পটি বর্তমানে সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, বাজারের উদ্বায়িতা, বৈশ্বিক ঘটনা যেমন কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে বিমান চলাচলে ব্যাঘাত, ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন। বায়বান্তরীক্ষ শিল্পে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখনও সুদৃঢ়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রটি একাধিক দেশের মধ্যে সফল অংশীদারিত্বের উদাহরণ। বৃহৎ মাপনীর প্রকল্পগুলিতে বিভিন্ন দেশের অংশীদারি অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ, কেননা একক রাষ্ট্রের পক্ষে ঐসব প্রকল্পের জটিলতা নিরসন ও উচ্চ ব্যয়ভার বহন করা দুরূহ।
তবে সামরিক চাহিদা, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সামরিক চাহিদা বায়বান্তরীক্ষ শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির মূল চালিকাশক্তি। যেমন ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য ও জার্মানির বিমান শিল্পগুলি বেশ ক্ষুদ্রায়তন ছিল, কিন্তু যুদ্ধের সময় এগুলি নাটকীয় হারে ফুলেফেঁপে ওঠে। এসময় বিমান ও বায়বান্তরীক্ষ প্রযুক্তিতে বিশাল প্রযুক্তিগত অভিনবত্বের বাস্তবায়ন ঘটে। জার্মানিতে রকেট ইঞ্জিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে জেট ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে আরও বহুসংখ্যক উদ্ভাবন ও নব্যতাপ্রবর্তন সম্পাদন করে। ১৯৪৭ সালে মার্কিন জেট বিমানগুলি শব্দাপেক্ষা দ্রুতগতি অর্জন করে এবং ১৯৫০-এর দশকে বৃহৎ যাত্রীবাহী বিমানগুলিকে চালানোর জন্য জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে প্রথম মহাকাশ যাত্রায় সফল হয়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চাঁদে অবতরণের মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়, ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম চাঁদে মানুষ প্রেরণ করে এটিতে জয়লাভ করে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে দুই পরাশক্তি মহাকাশ প্রযুক্তি ও প্রায়-মহাকাশ প্রযুক্তিতে একে অপরকে টেক্কা দেবার প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখে। দেশ দুইটি হাজার হাজার আন্তঃমহাদেশীয় নিক্ষেপী ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করে, সামরিক গোয়েন্দাগিরি, উন্নত যোগাযোগ ও আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্তে বহুসংখ্যক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করে, আর সৌরজগতের সব গ্রহ জরিপ করার জন্য মানববিহীন মহাকাশ সন্ধানী প্রেরণ করে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরে বায়বান্তরীক্ষ দ্রব্যের সামরিক চাহিদা কমার সম্ভাবনা তৈরি হলেও এটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতগুলির একটি। বিমান ও মহাকাশযানের নকশা আরও অনেক বেশি পরিশীলিত হয়েছে এবং এগুলিতে জ্বালানি সাশ্রয়, হ্রাসকৃত নিঃসরণ ও উন্নত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সংযুক্ত উপাদান, ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ ও উন্নত বৈদ্যুতিন বিমানচালনা ব্যবস্থা (এভিয়নিকস) এইসব অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাণিজ্যিক বায়বান্তরীক্ষ খাতটি এই শিল্পের একটি প্রাধান্যবিস্তারকারী শক্তি হিসেবে অব্যাহত থেকে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং ও ইউরোপের এয়ারবাস বাজারের ভাগের জন্য প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং উত্তোরত্তর অধিক জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশ-বান্ধব বিমান নির্মাণ করে চলেছে। চীন ও রাশিয়া থেকে নতুন প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটেছে। মহাকাশ অনুসন্ধান নতুন করে মনোযোগ ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। ব্যক্তিখাতের কোম্পানি যেমন স্পেসএক্স, ব্লু অরিজিন ও ভার্জিন গ্যালাকটিক মহাকাশ শিল্পে প্রবেশ করেছে এবং বাণিজ্যিক পর্যটনমুখী মহাকাশ যাত্রার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। সামরিক বায়বান্তরীক্ষ খাতটিও তার গুরুত্ব ধরে রেখেছে। এ খাতে স্টেলথ (রাডার থেকে অদৃশ্য) প্রযুক্তি, মানবহীন আকাশযান (ড্রোন) ও উপগ্রহ ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া অব্যাহত আছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সামরিক বায়বান্তরীক্ষ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে।
২১শ শতকের ২য় দশকে এসে বায়বান্তরীক্ষ শিল্প পরিবেশগত উদ্বেগগুলির দিকে নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর চাপ অনুভব করতে শুরু করে। কার্বন নিঃসরণ, শব্দ দূষণ ও বায়বান্তরীক্ষ শিল্প কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বৈদ্যুতিক ও সংকর বিমান উদ্ভাবন ও টেকসই বিমান জ্বালানির মতো বিষয়গুলি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ভবিষ্যতে খাতটির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। মহাকাশ অনুসন্ধান, বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহে অভিযান প্রেরণ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির একটি অন্যতম আগ্রহের বিষয়।