বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী
সেনাবাহিনী / From Wikipedia, the free encyclopedia
মধ্যযুগের অন্যতম পরাশক্তি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির প্রধান অংশ ছিল বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী বা পূর্ব রোমান সেনাবাহিনী, যা বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বাইজেন্টাইন সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। এই পূর্ব-রোমান বাহিনী তাদের পূর্বসূরী রোমান বাহিনীর শৃঙ্খলা, তুখোড় রণকৌশল এবং গঠনপ্রণালী অনেকাংশেই বজায় রাখে। মধ্যযুগীয় পশ্চিম ইউরেশিয়ায় সবচেয়ে সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এ বাহিনী। ৭ম শতাব্দীর শুরুতে রোমান লিজিয়ন প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় কালক্রমে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে এ বাহিনীর গঠনপ্রণালীতে জার্মানিক ও এশীয় বাহিনীসমূহের প্রভাব দেখা যায়[1]। প্রায়ই এ বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিজাতীয় সৈন্যদের নিয়োগ দেয়া হয়, যেমন: হান, কিউমান, অ্যালান এবং তুর্কী সৈন্য, এসব অশ্বারোহী বাহিনী অর্থের বিনিময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করে থাকত। বাইজেন্টাইন বাহিনী মূলতঃ এর সেনাপতিদের রণকৌশল ও দক্ষতার বলে স্বদেশী বেসামরিক বাহিনীসমূহকে (militia) কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করত, তবুও পদাতিক বাহিনীতে ফরাসী (ফ্র্যান্ক) এবং পরবর্তীতে ভ্যারাঞ্জিয়ান প্রভৃতি ভিনদেশীয় ভাড়াটে সৈন্যদের নিয়োগ দেয়া হত।
বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। (ডিসেম্বর ২০২০) |
বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী | |
---|---|
নেতা | রোমান সম্রাটগণ |
অপারেশনের তারিখ | খ্রি. ৩৯৫-১৪৫৩ |
সদরদপ্তর | কনস্টান্টিনোপল |
সক্রিয়তার অঞ্চল | বলকান, এশিয়া মাইনর, লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া, ইতালী, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, ককেশাস, ক্রিমিয়া |
এর অংশ | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য |
মিত্র | হান, লম্বার্ড, সার্ব, ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ, কাজার, রুশ, হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, অ্যাভার জাতি |
বিপক্ষ | গথ, হান, সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্য, ভ্যান্ডাল, অস্ট্রোগথ সাম্রাজ্য, অ্যাভার, স্লাভ জাতি, খিলাফতে রাশেদা, বুলগেরীয় সাম্রাজ্য, রুশ, নর্ম্যান জাতি, ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ, সেলজুক সালতানাত, উসমানীয় সাম্রাজ্য, আইয়ুবি সালতানাত, মামলুক সালতানাত সহ অন্যান্য |
খণ্ডযুদ্ধ ও যুদ্ধ | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের যুদ্ধসমূহ |
৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংগঠিত বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বাহিনীসমূহ এমনকি অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার ইসলামী খেলাফত বাহিনীও রণকৌশল ও সংগঠনগত দিক থেকে তাদের থেকে পিছিয়ে ছিল। ৭ম থেকে মধ্য ৯ম শতাব্দীতে তৎকালীন শক্তিশালী ইসলামী খেলাফত বাহিনীর প্রতিরোধ করতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য "থীম প্রথা" (Theme system) চালু করে, যা অনেকাংশেই তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষার ভূমিকা পালন করে। তবে, মধ্য ৯ম শতাব্দীর পরবর্তীতে তারা ক্রমশঃ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং এর ফলশ্রুতিতে সম্রাট ২য় নিকেফোরোস ফোকাস, জন জিমিসকেস ও ২য় বাসিলের মত সেনাপতি-সম্রাটগণের নেতৃত্বে ১০ম শতাব্দীতে তারা একের পর এক বিজয় অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তী কালের এ বাহিনীগুলো পূর্ববর্তী থীম বা জমিদারী বেসামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলনা বরং তাদের মূলভিত্তি ছিল সংগঠিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনী ও তাদের সাহায্যকারী শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী। এসময় তাদের অত্যন্ত সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাহায্যে তারা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহিনী গঠন করে এবং তাদের বহু হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়।
১১শ শতাব্দীতে থীম প্রথা বিলু্প্ত হওয়ায় বাইজেন্টাইনরা পেশাদার টাগমাটা বাহিনীসমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এসকল বাহিনীতে বিজাতীয় ভাড়াটে সৈন্যের সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। কোম্নেনীয় বংশের সম্রাটগণ একটি স্বদেশীয় সৈন্যেবাহিনী পুনর্নির্মাণে তৎপর হন এবং "প্রনইয়া" প্রথা চালু করেন, এ প্রথা অনুসারে স্বদেশীয়দের সেনাবাহিনীতে চাকরির মজুরি হিসেবে ভূমির ইজারা প্রদান করা হত। এতদসত্বেও সাম্রজ্যের বাহিনীতে ভাড়াটে সেনাদের বিপুল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ- এশিয়া মাইনরে বিস্তর ভূখণ্ড ও এর জনগোষ্ঠী তখন সাম্রাজ্যের হস্তচ্যুত হওয়ায় সেনাবাহিনীর জন্য লোকবলের অভাব হয়ে পড়ে। প্রকারান্তরে এই "প্রনইয়া" প্রথার কারণে সাম্রাজ্যে সামন্ততন্ত্রের (feudalism) প্রসার ঘটে। পরবর্তীতে অ্যাঙ্গেলোস রাজবংশের হাতে কোম্নেনীয় বংশের পতন হয়। এবং অবশেষে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ৪র্থ ক্রুসেডের ফলশ্রুতিতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয়।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পরে তাদের উত্তরসূরি নাইসিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাটগণ একই কাঠামোর একটি ছোট কিন্তু সুগঠিত বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যাতে স্বদেশীয় ও বিজাতীয় উভয় প্রকারের সেনাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ বাহিনী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট আনাতোলিয়া ভূখণ্ড প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম হয়। এবং পরবর্তীতে তারা বলকানের অনেকাংশ পুনরুদ্ধার করে এমনকি ১২৬১ খ্রিষ্টাব্দে তারা কনস্ট্যান্টিনোপল নগরীও পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। তবে সম্রাট ২য় অ্যান্ড্রোনিকোস প্যালিওলোগোস এর শাসনকালে পুনরায় অবহেলার দরুণ সেনাবাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং তৎকালীন উঠতি শক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে আনাতোলিয়া ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব হারায়। ১৪শ শতাব্দীতে একের পর এক গৃহযুদ্ধে এ সাম্রাজ্য একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের শক্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও বিলীন হয়ে আসে। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দূর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় নেতাদের ওপর সাম্রাজ্য কর্তৃত্ব হারায়। ফলে এককালের তুমুল ক্ষমতাশালী বাইজেন্টাইন বাহিনী কতিপয় ছোট ছোট বেসামরিক, ব্যক্তিগত ও ভাড়াটে বাহিনীর সমষ্টিতে পরিণত হয়।[2]