জাঞ্জিবার
ভারত মহাসাগরে তানজানিয়ার স্বশাসিত দ্বীপ অঞ্চল / From Wikipedia, the free encyclopedia
জাঞ্জিবার পূর্ব আফ্রিকার রাষ্ট্র তানজানিয়ার একটি স্বশাসিত দ্বীপ অঞ্চল। এটি তানজানিয়ার মূল মহাদেশীয় ভূখণ্ডের উপকূল থেকে ২৫-৫০ কিলোমিটার দূরত্বে ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জটি নিয়ে গঠিত। দ্বীপপুঞ্জটিতে অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপ ও দুইটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ দ্বীপ রয়েছে। স্থানীয় সোয়াহিলি ভাষায় দ্বীপ দুইটির নাম উঙ্গুজা (যেটি অনানুষ্ঠানিকভাবে জাঞ্জিবার দ্বীপ নামেও পরিচিত) ও পেম্বা দ্বীপ। উঙ্গুজা দ্বীপটি প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত। অন্যদিকে পেম্বা দ্বীপটি ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত। উঙ্গুজাতে জাঞ্জিবার অঞ্চলের রাজধানীটি অবস্থিত, যার নাম জাঞ্জিবার নগরী। জাঞ্জিবার নগরীটির ঐতিহাসিক কেন্দ্রটির নাম প্রস্তর নগর, এটিকে ২০০০ সালে একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দান করা হয়। এখানে আফ্রিকা, আরব, পারস্য, ভারত ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। এখানকার ভবনগুলি সুন্দর কারুকার্যে খোদাই করা কাঠের দরজার জন্য সুপরিচিত।
জাঞ্জিবার | |
---|---|
তানজানিয়ার স্বশাসিত অঞ্চল | |
তানজানিয়ার ভেতরে জাঞ্জিবারের অবস্থান | |
ভারত মহাসাগরে উঙ্গুজা ও পেম্বা - দুই প্রধান দ্বীপ | |
রাজধানী | জাঞ্জিবার সিটি |
দাপ্তরিক ভাষা | |
নৃগোষ্ঠী |
|
ধর্ম |
|
বিশেষণ | WaZanzibari |
সরকার | Federacy |
Hussein Ali Mwinyi | |
• First Vice President | Othman Masoud Sharif |
• Second Vice President | Hemed Suleiman Abdalla |
আইনসভা | House of Representatives |
আয়তন | |
• Total[2] | ২,৪৬২ কিমি২ (৯৫১ মা২) |
জনসংখ্যা | |
• 2012 আদমশুমারি | 1,503,569[3] |
• ঘনত্ব | ৫২৯.৭/কিমি২ (১,৩৭১.৯/বর্গমাইল) |
জিডিপি (মনোনীত) | ২০২০ আনুমানিক |
• মোট | $ 3,750 million[4] |
• মাথাপিছু | $2500 |
এইচডিআই (২০২০) | 0.720[5] উচ্চ |
মুদ্রা | Tanzanian shilling (TZS) |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি+3 |
ইউটিসি+3 | |
গাড়ী চালনার দিক | left |
কলিং কোড | +255 |
ইন্টারনেট টিএলডি | .tz |
জাঞ্জিবারের মূল শিল্পগুলি হল মসলা, রাফিয়া পাম ও পর্যটন।[6] ১৯শ শতক থেকে এখানে মসলার চাষ হয়। বিশেষ করে এখানকার দ্বীপগুলিতে লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, আদা ও কালো গোলমরিচ ফলে। জাঞ্জিবার (মূলত পেম্বা দ্বীপ) বিশ্বের বৃহত্তম লবঙ্গ উৎপাদক। এ কারণে জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জ ও তানজানিয়ার মাফিয়া দ্বীপকে একত্রে স্থানীয়রা মসলা দ্বীপপুঞ্জ নামে ডেকে থাকে। জাঞ্জিবারের দ্বীপগুলি শ্বেতশুভ্র বালুময় সৈকত ও বর্ণিল প্রবাল প্রাচীরের জন্য সুপরিচিত। নিরক্ষরেখার কাছে অবস্থিত এই দ্বীপগুলির জলবায়ু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও আর্দ্র প্রকৃতির এবং এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। জাঞ্জিবারে পর্যটন অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক একটি কর্মকাণ্ড। মূলত সরকারী প্রচারণার ফলে এখানে পর্যটকের সংখ্যা ১৯৮৫ সালে ১৯ হাজার থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ৩ লক্ষ ৭৬ হাজারে উন্নীত হয়।[7][8] দ্বীপগুলিতে পাঁচটি সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি আবেইদ আমানি কারুমে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি রয়েছে, যেটিতে প্রতি বছর ১৫ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করেন।[9]
জাঞ্জিবারের সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানটি অঞ্চলটির অর্থনীতির জন্য (মৎস্য আহরণ ও শৈবাল চাষ) গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানগুলি ভারতীয় মহাসাগরের মৎস্যকুলের জন্য এক ধরনের পোনা লালনপালন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এখানে স্বল্প আয়তনের মধ্যে জীববৈচিত্র্য অপেক্ষাকৃত বেশি। বেজি, ভোঁদড়, বাদুড়, সাপ, শূকর, হরিণ, ইত্যাদি ছাড়াও স্থানীয় জাঞ্জিবারের লাল কলোবাস বানর, জাঞ্জিবারের সার্ভালিন জেনেট (এক ধরনের বুনোবিড়াল), ও বিরল বা বিলুপ্তপ্রায় জাঞ্জিবারের চিতাবাঘ উল্লেখ্য।[10][11] পর্যটন ও মৎস্য খাতের চাপের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রসমতলের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে সমগ্র জাঞ্জিবার অঞ্চল জুড়ে পরিবেশ বিষয়ক আশংকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।[12]
জাঞ্জিবারের দ্বীপগুলিতে মূলত আফ্রিকান, আফ্রিকান-পারসিক মিশ্র (শিরাজি), আরব ও এশীয় বংশোদ্ভূত জাতির লোক বাস করে। এখানে সোয়াহিলি ভাষার একটি আরবি প্রাধান্যবিশিষ্ট রূপ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানকার লোকেরা মাছ, নারিকেল, ভাত, কাসাভা ও মিষ্টি আলুর খাবার খেয়ে থাকে।
জাঞ্জিবারের আদি অধিবাসীরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আগমন করেছিল। কিন্তু অনুকূল বাণিজ্যবায়ুর কারণে দ্বীপগুলি ভারতবর্ষ এবং লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটি আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব উপকূলের একটি বাণিজ্যকেন্দ্রই শুধু নয়, বরং আফ্রিকার অভ্যন্তরভাগে অভিযানের প্রারম্ভবিন্দু হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১০ম শতকে এখানে পারস্য থেকে (মূলত শিরজ শহর থেকে) লোক আসতে শুরু করে। আরব ও পারসিকেরা এখানে ক্রীতদাস, হাতির দাঁত ও মসলা বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল। ১৫শ শতকে এখানে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে এবং ১৫শ ও ১৬শ শতকে প্রায় ২ শতাব্দী ধরে পর্তুগিজরা জাঞ্জিবার নিয়ন্ত্রণ করে। ১৭শ শতকে (১৬৯৮) ওমান থেকে আগত আরবেরা দ্বীপটি বিজয় করে নেয়। ওমানের সুলতান ১৯শ শতকে (১৮৩২ সালে) তাঁর রাজধানী জাঞ্জিবারে স্থানান্তরিত করেন। এসময় আফ্রিকান ক্রীতদাস বাণিজ্য দেশটির অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখত। এরপর প্রায় দেড়শত বছর ধরে ওমানিরা দ্বীপটি শাসন করে ও আরব জাতির লোকেদের কাছে দ্বীপটির অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। ১৮৬১ সালে জাঞ্জিবার ওমানের সুলতানশাহী থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। তারপরেও এখানে আরব শাসকদের আধিপত্য বজায় থাকে ও ক্রীতদাস বাণিজ্য অব্যাহত থাকে। ১৮৭৮ সালে এসে জাঞ্জিবারের ক্রীতদাস বাণিজ্য বন্ধ করা হয়। ১৮৮৬ সালে জার্মানরা ব্রিটিশদের সাথে এক বোঝাপড়ায় জাঞ্জিবার-সংলগ্ন তাংগানিকা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৮৯০ সালে যুক্তরাজ্য জাঞ্জিবারকে একটি প্রতিরক্ষাধীন রাজ্যে পরিণত করে। ১৮৯০ থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য জাঞ্জিবার পরিচালনা করে; তবে জাঞ্জিবারের আরব সুলতান মোটামুটি স্বাধীনভাবেই কাজ করতেন। তা সত্ত্বেও জাঞ্জিবারের মসলা খামারগুলিতে আফ্রিকার কৃষাঙ্গ শ্রমিকেরা (প্রাক্তন ক্রীতদাস) তাদের ভাগ্যের কোনও উন্নতি দেখেনি। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জাঞ্জিবার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির আফ্রো-শিরাজি দলটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও ব্রিটিশ ও আরব শাসকদের মধ্যে আঁতাতের কারণে সরকার গঠনে বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্বাধীনতার মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে স্থানীয় সংখ্যাগুরু আফ্রিকানরা বামপন্থী আফ্রো-শিরাজি দলের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে জাঞ্জিবারের ব্রিটিশ মদদপুষ্ট আরব সুলতান ও শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে। বিদ্রোহ পরবর্তী জাতিগত দাঙ্গায় আরও বহু হাজার (মতভেদে ২ থেকে ২০ হাজার) সংখ্যালঘু আরবের প্রাণহানি হয়। স্বাধীনতার আগে জাঞ্জিবারের জনসংখ্যার ২০% ছিল আরব বংশোদ্ভূত; বিপ্লবের পরে বহু আরব জাঞ্জিবার ত্যাগ করে। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় নাগরিকেরাও জাঞ্জিবার ত্যাগ করে। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাঞ্জিবারে দুইশত বছরের আরব আধিপত্যের সমাপ্তি ঘটে। এর পরে ১৯৬৪ সালেই পূর্ব আফ্রিকার তাংগানিকা ও জাঞ্জিবার একীভূত হবার সিদ্ধান্ত নেয় ও তানজানিয়া প্রজাতন্ত্র নামক দেশটি গঠন করে। তানজানিয়া নামটিতে এই দুই দেশের নামের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। তবে আরব ও অনারব আফ্রিকান ও মিশ্র জাতির লোকদের মধ্যে উত্তেজনা এখনও চলমান। জাঞ্জিবারের প্রায় সব অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সম্প্রতি ২১শ শতকে আপাতদৃষ্টিতে সরকারি অবহেলার কারণে আশাহত যুবাদের মধ্যে ইসলামি জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটেছে।