গ্রহীয় সমুদ্রবিজ্ঞান
পৃথিবীর বাইরের গ্রহ-উপগ্রহে উপস্থিত সমুদ্র নিয়ে গবেষণা / From Wikipedia, the free encyclopedia
গ্রহীয় সমুদ্রবিজ্ঞান, নভোসমুদ্রবিজ্ঞান, জ্যোতিঃসমুদ্রবিজ্ঞান বা বহির্গ্রহীয় সমুদ্রবিজ্ঞান[1] বলতে পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত অন্যান্য গ্রহ ও উপগ্রহগুলিতে অবস্থিত সমুদ্রসমূহ অধ্যয়নকারী বিদ্যাকে বোঝায়। অনুরূপ অন্যান্য বিজ্ঞান যেমন জ্যোতিঃজীববিজ্ঞান, জ্যোতিঃরসায়ন ও গ্রহীয় ভূতত্ত্বের মতো নয়, বরং শনিগ্রহের উপগ্রহ টাইটান ও বৃহস্পতি গ্রহের ইউরোপাতে ভূগর্ভস্থ মহাসমুদ্র আবিষ্কারের পরেই কেবল এই শাস্ত্রটির সূচনা হয়।[2][3] বিভিন্ন উপগ্রহের শিলা বা বরফস্তরের নিচে অবস্থিত মহাসমুদ্রগুলিতে মানবপ্রেরিত অভিযানগুলি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এই গবেষণাক্ষেত্রটি বর্তমানে মূলত অনুমাননির্ভর অবস্থাতেই বিদ্যমান। সৌরজগতে মহাসমুদ্র, এমনকি নভোবস্তুদের মহাসমুদ্র বিশ্ব নিয়েও অনেক তত্ত্ব আছে, যাদের মধ্যে নেপচুন গ্রহে হীরার তৈরি মহাসমুদ্র কিংবা বৃহস্পতি গ্রহের নিচে অবস্থিত তরল হাইড্রোজেনের অতিবিশাল মহাসমুদ্র বিষয়ক তত্ত্বগুলি উল্লেখ্য।[4][5]
কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী মঙ্গল গ্রহ ও শুক্র গ্রহের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের শুরুর দিকে সেগুলিতে বিশাল জলপূর্ণ মহাসমুদ্র ছিল। মঙ্গলগ্রহ মহাসমুদ্র অনুমান অনুযায়ী মঙ্গলগ্রহপৃষ্ঠের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানি দিয়ে আবৃত ছিল, আর একটি লাগামহীন চারাঘর প্রতিক্রিয়ার কারণে শুক্রগ্রহের সামগ্রিক মহাসমুদ্রটি স্ফুটন প্রক্রিয়াতে উবে গিয়েছে। লবণ ও অ্যামোনিয়া জাতীয় যৌগগুলি পানিতে দ্রবীভূত হলে পানির হিমাঙ্ক নেমে যায়, তাই ভূ-বহিঃস্থ পরিবেশ যেমন ব্রাইন বা পরিচলনশীল বরফে ঐ ধরনের পানি বৃহৎ পরিমাণে উপস্থিত থাকতে পারে। অনেক বামন গ্রহ ও উপগ্রহের পৃষ্ঠতলের নিচে মহাসমুদ্র আছে বলে অনুমান করা হয়েছে, তবে সেগুলির কোনও নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয়নি। বিশেশ করে ইউরোপা নামক উপগ্রহে যা জলসমুদ্রতি আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেটিতে সঞ্চিত পানির পরিমাণ সমগ্র পৃথিবীর পানি দ্বিগুণ হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। সৌরজগতের দানব গ্রহগুলির আবহমণ্ডলগুলিতে তরল স্তর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তবে সেগুলি কী দিয়ে গঠিত, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এছাড়া বহির্গ্রহ ও বহিঃউপগ্রহগুলিতেও মহাসমুদ্র থাকতে পারে। এগুলির মধ্যে একটি পরিনাক্ষত্রিক বাসযোগ্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে তরল পানি দিয়ে গঠিত পৃষ্ঠতলীয় মহাসমুদ্রগুলিও অন্তর্ভুক্ত। এমন অনুকল্পিত গ্রহও থাকতে পারে, যেগুলির পৃষ্ঠতল সম্পূর্ণ জলে আবৃত; এদেরকে মহাসামুদ্রিক গ্রহ নাম দেওয়া হয়েছে।[6][7]
পৃথিবী-বহিঃস্থ (বহির্জাগতিক) মহাসমুদ্রগুলি জল (পানি) কিংবা অন্য কোনও রাসায়নিক মৌল বা যৌগ দিয়ে গঠিত হতে পারে। গ্রহ বা উপগ্রহের পৃষ্ঠতলগুলির মধ্যে এ পর্যন্ত একমাত্র যে বৃহৎ আকারের স্থিতিশীল তরলরাশিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তা হল টাইটানের হ্রদসমূহ, যেগুলি জল (পানি) নয়, বরং হাইড্রোকার্বন যৌগ নিয়ে গঠিত। তবে সৌরজগতের অন্যত্র পৃষ্ঠতলের নিচে ভূগর্ভস্থ পানির মহাসাগরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্যমান। সৌরজগতে এরূপ ভূগর্ভস্থ মহাসাগরগুলি যে গ্রহ বা উপগ্রহগুলিতে থাকার সম্ভাবনা সর্বাধিক, সেগুলি হল বৃহস্পতি গ্রহের ইউরোপা, গ্যানিমিড ও ক্যালিস্টো উপগ্রহ তিনটি এবং শনির এনসেলাডাস ও টাইটান নামক দুইটি উপগ্রহ।[8]
এ পর্যন্ত জানামতে সৌরজগতের একমাত্র যে গ্রহটির পৃষ্ঠতলে বিপুল পরিমাণে স্থিতিশীল তরল জল (পানি) বিদ্যমান, তা হল পৃথিবী। তবে অন্যান্য নভোবস্তুতে বৃহৎ মহাসাগর থাকার সম্ভাবনা আছে।[9] ২০২০ সালের জুন মাসে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা গাণিতিক প্রতিমান নিয়ে করা গবেষণার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন দেন যে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে বহিঃগ্রহগুলিতে মহাসমুদ্রের উপস্থিতি একটি সাধারণ ব্যাপার হতে পারে।[10][11]
গ্যাসীয় দানব গ্রহগুলিতে অভ্যন্তরীণ গঠনকাঠামো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও সীমিত। বিজ্ঞানীরা সন্দেহ পোষণ করেন যে চরম চাপের অধীনে হাইড্রোজেন গ্যাস একটি অতিক্রান্তিক প্রবাহী হিসেবে আচরণ করবে, তাই বৃহস্পতি গ্রহের মত গ্যাসীয় দানব গ্রহগুলির ভেতরে অনেক গভীরে তরল হাইড্রোজেনের মহাসাগর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।[12][13] এছাড়া বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে হিমদানব গ্রহগুলিতে, বিশেষ করে নেপচুন ও ইউরেনাস গ্রহতে তরল কার্বনের সমুদ্রের অস্তিত্ব আছে।[14][15] যেকোনও গ্রহেই (এবং কিছু কিছু উপগ্রহে) বিবৃদ্ধিমূলক পর্যায়টিতে ম্যাগমা মহাসমুদ্র থাকতে পারে, যে সময় গ্রহ বা উপগ্রহ সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে গলন্ত অবস্থায় বিরাজ করে।[16]