কু ক্লাক্স ক্লান
From Wikipedia, the free encyclopedia
কু ক্লাক্স ক্লান, সংক্ষেপে কেকেকে, আমেরিকার অতীতে ঘটে যাওয়া এবং বর্তমানে চলমান কয়েকটি আন্দোলনের সমষ্টি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গ প্রাধিকার, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন বিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে জড়িতরা আমেরিকার সমাজ ব্যাবস্থাকে "বিশুদ্ধ" করার নামে এই আন্দোলন পরিচালনা করছে, যারা প্রধানত ডানপন্থী উগ্রবাদী সংগঠন।
এই নিবন্ধটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। |
অস্তিত্ব | |
---|---|
১ম ক্লান | ১৮৬৫–১৮৭১ |
২য় ক্লান | ১৯১৫–১৯৪৪ |
৩য় ক্লান | ১৯৪৬–বর্তমান |
সদস্য | |
১ম ক্লান | অজানা |
২য় ক্লান | ৩০,০০,০০০–৬০,০০,০০০[1] (১৯২৪–১৯২৫) |
৩য় ক্লান | ৫,০০০–৮,০০০[2] |
বৈশিষ্ট্য | |
রাজনৈতিক মতাদর্শ |
|
রাজনৈতিক অবস্থান | ডানপন্থী |
Espoused religion |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা থাকবে কি থাকবে না মূলত তা নিয়েই ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি মার্কিন ফেডারেল সরকারের সঙ্গে দক্ষিণের ১১ টি অঙ্গরাজ্যের তীব্র সংঘাত চলে। এই অধ্যায়টি মার্কিন ইতিহাসে ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার’ নামে পরিচিত। মার্কিন গৃহযুদ্ধের পর মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়-যে অধিকার থেকে আগে তারা বঞ্চিত ছিল। এই সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ হিসেবে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার দক্ষিণে কু ক্লাক্স ক্লান নামে একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে ওঠে -যে সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের আধিপত্য বজায় রাখা। ক্লানের সদস্যরা ছিল অধিকাংশই প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অনুসারী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক । তিনটি ধাপে এদের গুপ্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল। উনিশ শতকে, কুড়ি শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং কুড়ি শতকের ষাটের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত।
কু ক্লাক্স ক্লান বা সংক্ষেপে kkk-এর এর উদ্ভব গ্রিক শব্দ kuklos থেকে। এর দুটো মানে হতে পারে। একটি হল চক্র, যে চক্রে বিদ্যমান শ্বেতাঙ্গ আর্য নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট; অপরটি হল শ্বেত র্যাডিকাল ব্রাদারহুড। প্রায় দেড়শ বছর ধরে এদের অপতৎপরতা জাতি হিসেবে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিচ্ছে যা হোক! ক্লান সদস্যরা ক্লান সদস্যদের নানান উপাধি ছিল- যেমন, গ্র্যান্ড ড্রাগন, গ্র্যান্ড স্লাইক্লোপস কিংবা ইম্পেরিয়াল উইজার্ড।
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে কু ক্লাক্স ক্লান এর সদস্যরা মাথা ঢেকে সাদা আলখাল্লা ও মুখোশ পরে নিরপরাধ আমেরিকান ব্ল্যাকদে খুন করা শুরু করে। এদের অপতৎপরতার মধ্যে রয়েছে-খুন, ফাঁসী, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন ও বোমাবাজি। এরা অ্যান্টি-সেমিটিক ও অ্যান্টি- ক্যাথলিক ছিল। একই সঙ্গে অভিবাসী (ইমিগ্রান্ট), ইহুদি ও কমিউনিষ্টদের ওপর আক্রমণ করত। কু ক্লাক্স ক্লান হোয়াইট ব্রাদারহুড, হিরোজ অভ অ্যামেরিকা, কনসটিটিউশনাল ইউনিয়ন গার্ডস, দ্য মেন অভ জাস্টিস, দ্য নাইটস অভ দি হোয়াইট ক্যামেলিয়া এবং ইনভিজিবল এমপায়ার নামেও পরিচিত।
মার্কিন ইতিহাসে পুনর্নির্মাণ বা রিকন্সট্রাকশন বলে এক অধ্যায় আছে। এই পুনর্নিমার্ণের সময়কাল ১৮৬৫-১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ে যে সব অঙ্গরাজ্য কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে কনফেরাডিসি থেকে সরে গিয়েছিল ফেডালের সরকার তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই সময়ে দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চরমপন্থী শ্বেতকায়রা আক্রমণ শুরু করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল ‘বিশুদ্ধ মার্কিনবাদ’ প্রতিষ্ঠা করা।
ক্লান সদস্যরা কৃষ্ণাঙ্গ কাউকে হত্যা করার আগে তার বাড়ির সামনে কাঠের ক্রশ পুঁতে আগুন ধরিয়ে দেয়।এর উদ্দেশ্য হল কৃষ্ণাঙ্গ লোকটি যেন সেখান থেকে চলে যায়। এই ক্রশ পোড়ানো ক্লানের প্রকৃত সদস্যরা নাকি সমর্থন করেনি। ডিক্সন নামে জনৈক ঔপন্যাসিকের লেখায় এই ধারণার উৎপত্তি।
আমি আগেই একবার বলেছি, গৃহযুদ্ধের পর মার্কিন কংগ্রেসের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সহানুভূতিশীল সদস্যরা শ্বেতাঙ্গ শক্তির উৎস ধ্বংস করতে উদ্যেগী হয়ে ওঠে। তারা ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ ‘ফ্রিম্যান্স বিউরো’ প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রিম্যান্স বিউরো প্রাক্তন দাসদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য এরা চাকরির ব্যবস্থা করত; শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করত। ফ্রিম্যান্স বিউরো ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৪০০০ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭,০০০,০০০ ডলার ব্যয় করে। সেই সঙ্গে ১০০ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে। তবে এসব সহজে হয়নি। বিরোধী পক্ষের তুমুল বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।। ফ্রিম্যান্স বিউরোর উদ্যেগের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জনসন ১৮৬৬ সালের ফেব্র“য়ারিতে ভেটো প্রয়োগ করেন। পরের বছরও ‘সিভিল রাইট বিল’-এর বিরুদ্ধেও ভেটো প্রয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জনসন ।
উনিশ শতকের একটি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান পরিবার। এদের ওপর ছিল ‘ব্ল্যাক কোডেস’ এর অভিশাপ। এই কোডেস অনুযায়ী এদের ভোটাধিকার ছিল না, জুরীতে বসতে পারত না, শ্বেত মার্কিনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারত না, অস্ত্র বহন করতে পারত না, কিছু পেশায় কাজ করতে পারত না ... ইত্যাদি...ইত্যাদি। সিভিল রাইট বিল ছিল ব্ল্যাক কোডেস এর বিরুদ্ধে। যে বিলের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জনসন। ফ্রিম্যান্স বিউরোর সদস্যরা ছিলেন কালো আইনের বিরুদ্ধে ছিল।
স্বাভাবিক কারণেই ফ্রিম্যান্স বিউরোর সদস্যদের মানবিক পদক্ষেপ সমূহ গৃহযুদ্ধে পরাজিত সাদারা ক্ষেপিয়ে তুলছিল। এবং মানবিক পদক্ষেপ বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াসরূপ টেনেসি অঙ্গরাজ্যের পুলাক্সি শহরে মে মাসে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বর্ণবাদী মার্কিন সংগঠন কু ক্লাক্স ক্লান-এর প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক বছর পর ন্যাশভিলে কু ক্লাক্স ক্লান-এর আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এদের বেশির ভাগই প্রাক্তন কনফেডারেট সৈন্য। এবং কু ক্লাক্স ক্লান-এর প্রথম গ্র্যান্ড উইজার্ড হলেন লেফটেনান্ট জেনালের নাথান বেডফোর্ড ফরেস্ট।
লেফটেনান্ট জেনালের নাথান বেডফোর্ড ফরেস্ট। অত্যন্ত দক্ষ ও কৌশলী সমরবিদ। ইনি কু ক্লাক্স ক্লান- কে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে আধা সামরিক রূপ দিয়েছিলেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালের মধ্যেই কু ক্লাক্স ক্লান দ্রুত গতিতে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
কু ক্লাক্স ক্লান-এর সদস্যরা Klansmen নামে পরিচিত ছিল। ক্লানসমেনরা পরের ২ বছর মুখোশ, সাদা কার্ডবোর্ডের হ্যাট ও সাদা আলখাল্লা পরে কৃষ্ণাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের ওপর বিভৎস নির্যাতন শুরু করে। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য এরা অভিবাসীদের দায়ী করে এবং অভিবাসীদের ওপরও হামলা করে। কু ক্লাক্স ক্লান-এর সদস্যরা ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নর্থ কারোলিনা, টেনেসি ও জর্জিয়ায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্টা করতে সক্ষম হয়।
রেগালিয়া। ক্লানসমেনদের পোশাক । কখনও এই পোশাককে বলে ‘গ্লোরি স্যূট’।
কু ক্লাক্স ক্লান বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুনখারাপিও অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। অবশ্য নিরীহ মানুষ হত্যা করায় এরা সাধারন মার্কিনী সমর্থন হারাতে থাকে। কয়েক বছর পর দেখা গেল যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সংগঠনের অঢেল সম্পদ অর্জিত হয়েছিল। সে সব নিয়ে সদস্যদের মধ্যে কাড়াকাড়ি চলছিল। কু ক্লাক্স ক্লান এর উপরের সারির নেতাদের কেলেঙ্কারির পর কেলেঙ্কারি সাধারন মার্কিনীদের উষ্মার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুখে ধর্মের কথা বললেও নেতাদের যৌন কেলেঙ্কারি ও মদ্যপানে আসক্তির কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া, মার্কিন সরকার সমর্থিত সামরিক বাহিনী কু ক্লাক্স ক্লান এর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেনাবাহিনী এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, হুমকি দেয়। নির্যাতিত কালোরাও কু ক্লাক্স ক্লান এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮৮২ সালে সুপ্রিম কোর্ট কু ক্লাক্স ক্লান কে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করে। কু ক্লাক্স ক্লান এর নানা পদক্ষেপকে ষড়যন্ত্র বলে বিবেচনা করে। এসব কারণে গুপ্ত সংগঠনটি দূর্বল হতে থাকে । ১৮৭০ সালের দিকে পোশাক (রেগালিয়া) বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। সংগঠনটি পরিনত হয় নিছক প্রতিষ্ঠানে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের কু ক্লাক্স ক্লান-এর সদস্যরা প্রায় সবাই ছিল আটলান্টার অধিবাসী। নিজেদের বলত: ‘নাইটস অভ ম্যারি ফাগান’।
কু ক্লাক্স ক্লান-এর দ্বিতীয় পর্যায়র সময়কাল ১৯১৫ থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ। (অবশ্য পর্যায় নিয়ে মতভেদ রয়েছে) ; দ্বিতীয় পর্যায়র নেতৃত্ব দেন উইলিয়াম জে সিমন্স। সেই পুরোনো কৃষ্ণবিরোধী আদর্শ নিয়ে আটলানটার বাইরে স্টোন মাউন্টেনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য সময় বদলেছে বলে এবার গুপ্ত চক্রটি নতুন কিছু বিষয় ছিল। যেমন, ক্যাথলিক ও অভিবাসী বিরোধীতা। আরও যুক্ত হয় আরব ও ইহুদি বিরোধী ধ্যানধারণা।